পবিত্র কুরআন শারীফ তিলাওয়াত ও তাজবীদ জানার গুরুত্ব

পবিত্র কুরআন শারীফ তিলাওয়াত ও তাজবীদ জানার গুরুত্ব

Oct 5, 2024 - 16:53
Oct 5, 2024 - 16:57
 0  12
পবিত্র কুরআন শারীফ তিলাওয়াত ও তাজবীদ জানার গুরুত্ব

 

দুনিয়াতে সর্বশেষ নাযিলকৃত কিতাব হইতেছে আল-কুরআনুল কারীম। প্রতিদিন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি এই কিতাবই পঠিত হয়। এই কিতাব পাঠ ও ইহাকে মুখস্ত রাখিবার ব্যাপারে এত বেশী তাগিদ ও গুরুত্ব হাদীসের কিতাবসমূহে আসিয়াছে যাহার প্রতি কোন মুসলমানই অবহেলা প্রদর্শন করিতে পারেন না। নামাযের মধ্যেও এই কিতাবের কিছু অংশ পাঠ করা ফরয। হাদীস শারীফে আসিয়াছে,

عَنْ عُثْمَانَ رَضِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ (بخاری)

১. হযরত উসমান (রদিয়াল্লহু আনহু) হইতে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফরমাইয়াছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম, যিনি কুরআন শারীফ স্বয়ং শিখিয়াছেন এবং অপরকেও শিক্ষা দিয়াছেন। (বুখারী শারীফ, হাদীছ নং ৫০২৭)।

عَنْ نُعْمَانَ بْنِ بَشِيْرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْضَلُ عِبَادَةِ أُمَّتِي تِلَاوَةُ الْقُرْآنِ (بيهقى)

২. হযরত নু'মান ইবনে বাশীর (রদিয়াল্লহু আনহু) হইতে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফরমাইয়াছেন, আমার উম্মতের সর্বোত্তম ইবাদত হইল কুরআন শারীফ তিলাওয়াত। (বায়হাকী শারীফ, শুয়াবুল ঈমান হাদীছ নং ২০২২)

৩। ইবনে মাসউদ (রদিয়াল্লহু আনহু) বলেন, রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি কুরআনুল কারীমের একটি হারফ (অক্ষর) পাঠ করিল, উহার বিনিময়ে সে একটি নেকী লাভ করিল এবং উক্ত একটি নেকী দশটি নেকীর সমতুল্য হইবে। আমি (রসূল ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলি না যে, ১। একটি হাফ; বরং আলিফ একটি হার্ফ, লাম একটি হাফ এবং মীম একটি হাফ। (তিরমিযী শারীফ, হাদীছ নং ২৯১০)

 

৪। হযরত মুয়াজ জুহানী (রদিয়াল্লহু আনহু) হইতে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি কুরআন শারীফ পড়ে ও উহার উপর আমল করে, তাহার মাতাপিতাকে কিয়ামতের দিন এমন একটি (নূরের) টুপি পরানো হইবে যাহার জ্যোতি: সূর্যের জ্যোতি: হইতেও অধিক হইবে। যদি এই সূর্য তোমাদের ঘরের মধ্যে উদিত হইত! অতএব, যে স্বয়ং কুরআন শারীফের উপর আমল করে তাহার সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা হইতে পারে? (আবু দাউদ শারীফ, হাদীছ নং ১৪৫৩)

৫। হযরত সাঈদ বিন সুলাইম (রদিয়াল্লহু আনহু) হইতে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলিয়াছেন, কিয়ামতের দিন আল্লহ্ তা'লার দরবারে কালামে পাকের চেয়ে বড় কোন সুপারিশকারী আর কেহ হইবেন না, কোন নবীও নন এবং কোন ফিরিশতাও নন। (শরহে ইয়াহ্ইয়া, ৪র্থ খন্ড পৃষ্ঠা নং ৪৬৩)

 

৬। রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলিয়াছেন, কুরআন শারীফ মুখস্ত পড়ায় এক হাজার ছাওয়াব পাওয়া যায় এবং দেখিয়া পড়ার মধ্যে দুই হাজার গুণ পর্যন্ত ছওয়াব বর্ধিত হইয়া যায়। (বায়হাকী শারীফ, শুয়াবুল ঈমান হাদীছ নং ২২১৮)

৭। হযরত ইবনে আব্বাস (রদিয়াল্লহু আনহু) বলেন, রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, যাহার অন্তরে আল- কুরআনের কোন শিক্ষা নাই, উহা বিরান ঘর সমতুল্য। (তিরমিযী শারীফ, হাদীছ নং ২৯১৩)

বিরান ঘর অর্থ শূন্য ঘর, বাস করিবার অনুপযোগী ঘর। যেখানে শয়তানের প্রভাব কায়েম থাকে।

৮। হযরত আনাস (রদিয়াল্লহু আনহু) এর রিওয়ায়েতে হযরত রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে কিন্তু ইহার পর তাহাকে বন্ধ করিয়া গৃহে ঝুলাইয়া রাখে, রীতিমত তিলাওয়াতও করে না এবং উহার বিধানাবলীও পালন করে না, কিয়ামতের দিবসে সে গলায় কুরআন ঝুলন্ত অবস্থায় উত্থিত হইবে। কুরআন আল্লহ তা'আলার দরবারে অভিযোগ করিয়া বলিবে, আপনার এই বান্দা আমাকে ত্যাগ করিয়াছিল। এখন আপনি আমার ও তাহার ব্যাপারে ফায়ছালা দিন। (কুরতুবী, ১৩ তম খন্ড পৃষ্ঠা নং ২৫, তাফসীরে মা'আরিফুল কুরআন ১৯ নং পারা পৃষ্ঠা নং ৭)

কুর'আন শারীফ তিলাওয়াত না করিবার কারণে কিয়ামতের কঠিন সময়ে আল্লহ রব্বুল আ'লামীনের দরবারে কোন বান্দার বিরুদ্ধে যদি স্বয়ং আল- কুরআন কর্তৃক অভিযোগ পেশ করা হয় তাহা হইলে অবস্থা কেমন হইবে? বিষয়টি ঠান্ডা মাথায় ভাবিয়া দেখা উচিত।

ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রহমাতুল্লহ আলাইহি) এর মতে, কুর'আন শারীফের হক হইল বৎসরে দুই খতম পড়া। সুতরাং উহার

চাইতে কম হওয়া কিছুতেই উচিৎ নয়। (ফাযায়েলে কুরআন) কুর'আনুল কারীম নিয়মিত তিলাওয়াত না করার পরিণাম সম্পর্কে আর- নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত আয়াতটির মর্মার্থ যথাযথভাবে অবগত হওয়ার জন্য পাঠকবৃন্দকে সবিনয় অনুরোধ করিতেছি।

وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هُذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا .

অর্থঃ রসুল (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, হে আমার পালনকর্তা। আমার সম্প্রদায় এই কুর'আনকে পরিত্যাগ করিয়াছে। (১৮ পারা সূরা ফুরকান আয়াত ৩০)

কুর'আন শারীফ তিলাওয়াতের ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক আয়াত ও হাদীস হইতে এখানে মাত্র কয়েকটির অনুবাদ উল্লেখ করা হইল। বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য এইগুলিই যথেষ্ট। নামাযের মধ্যে কুর'আন শারীফ হইতে কিছু অংশ পাঠ করা ফরয। নামাযের মধ্যে তিলাওয়াত অশুদ্ধ হইলে নামাযও অশুদ্ধ হইবে। সহীহ তিলাওয়াতের জন্য তাজবীদের আইন কানুনগুলি জানা প্রতিটি নামাজীর জন্য অপরিহার্য।

উল্লেখ্য, আল্লহ তা'লার এক নাম رَبُّ الْعلمين (রব্বুল আ'লামীন) অর্থ সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রভু। রসূল (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এক নাম رَحْمَةً لِّلْعَلَمِينَ (রহমাতুল্লিল আ'লামীন) অর্থ সমগ্র সৃষ্টিজগতের রহমত। পবিত্র কুরআনের এক নাম ذِكْرُ لِّلْعَلَمِين (জিকরুল্লিল আ'লামীন) অর্থ সমগ্র সৃষ্টিজগতের জিকির বা নছীহত। সমগ্র সৃষ্টি জগতের স্রষ্টার নিকট হইতে رُوحُ الْأمين (রূহুল আমীন) বিশ্বস্ততম ফিরিশতা জিবরীল (আলাইহিস সালাম) সর্বশ্রেষ্ঠ রাত্রে (লাইলাতুল কদরে) সর্বশ্রেষ্ঠ কালাম আল-কুরআনুল হাকীম সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মুহাম্মাদুর রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট পৌছাইয়াছিলেন। এখন ভাবুন, যে কোন দায়সারাভাবে তিলাওয়াতকরত: নামাজ আদায় করা কি কোন মুসলমানের উচিৎ হইবে? কখনই নয়। হযরত জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যেভাবে তিলাওয়াত করিয়া রসূল (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে শুনাইয়াছেন এবং একইভাবে রসূল (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীদের (রদিয়াল্লহু আনহুম)কে যেইভাবে তিলাওয়াত শিক্ষা দিয়াছেন সেইভাবে তিলাওয়াত করাই আমাদের উচিৎ। উল্লেখ্য যে, কালামে পাক নাজিলের সহিত তাজবীদও নাজিল হইয়াছে।

 

تَجْوِيدٌ (তাজবীদ) অর্থ উন্নতি সাধন, উৎকর্ষ সাধন। ভাষাগত অর্থে প্রতিটি হারকে অন্য হার্ফ হইতে পৃথক করিয়া তাহার নির্ধারিত মাখরজ (উচ্চারণ স্থান) হইতে যথাযথ ছিফাত (গুণ) অনুযায়ী সহজে তিলাওয়াত করাকে تَجْوِيدٌ (তাজবীদ) বলে। সমস্ত ইলমের মধ্যে ইলমে তাজবীদই সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ এই বিদ্যা আল্লহ রব্বুল আ'লামীনের কালাম আল- কুরআনের সহিত সরাসরি সম্পর্কিত। আল-কুরআনুল কারীমকে তাজবীদের সহিত তিলাওয়াত করা ফরয, যেমন নামাজ ফরয। তাজবীদের বিপরীত তিলাওয়াত করা হারাম।

সহীহভাবে তিলাওয়াতের জন্য প্রতিটি আরবী হারফ্ফের নামের সঠিক উচ্চারণ এবং হারকাতযোগে তাদের উচ্চারণ জানা একান্ত প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাফগুলির নামের উচ্চারণ ও হারকাতযোগে উচ্চারণ ভুল করা হয়। তিলাওয়াতের শুরুতে এ বিষয়ে সতর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ

ক. সূরা ফাতিহা আয়াত ১,

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَةٌ

অর্থঃ সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক আল্লাহ তা'আলার জন্যই সমস্ত প্রশংসা।

খ. ১৭ পারা সূরা আম্বিয়া আয়াত ১০৭,

وَمَا أَرْسَلْتُكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَلَمِينَ .

অর্থ : আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের রহমতস্বরূপই প্রেরণ করিয়াছি।

গ. ২৯ পারা সূরা আল-কুলাম আয়াত ৫২,

وَمَا هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعَلَمِينَ .

অর্থ: ইহা (আল-কুরআন) তো সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য নছীহত।

ঘ. ১৯ পারা সূরা শু'আরা আয়াত ১৯৩,

نزل بِهِ الرُّوحُ الأمين لي

অর্থ: উহাকে (আল-কুরআনকে) বিশ্বস্ততম ফিরিশতার মাধ্যমে নাজিল করা হইয়াছে।

৬. ৩০ পারা সূরা আলক্বদর আয়াত ৩,

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرَهُ

অর্থঃ কদরের রাত্রি হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম,

অর্থ্যাৎ এই রাত্রিতে ইবাদতের ছওয়াব এক হাজার মাসের ইবাদতের ছওয়াব অপেক্ষাও উত্তম। আর এক হাজার মাস হইতেছে তিরাশি বছর চার মাসের সমান।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow