ছহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফযীলত | কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম ও পুরস্কার
কুরআন তিলাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি ও তাজবীদের গুরুত্ব কী? হাদীস ও কুরআনের আলোকে জেনে নিন ছহীহভাবে কুরআন পড়ার ফযীলত, পুরস্কার ও মর্যাদা। কুরআনের সৌন্দর্য বাড়াতে কণ্ঠের ভূমিকা ও তাজবীদের প্রয়োজনীয়তা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ কিতাব, পবিত্র কুরআন মাজীদ, মানবজাতির জন্য এক আলোকিত পথনির্দেশ। এটি শুধুমাত্র পাঠের গ্রন্থ নয়, বরং জীবন পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। কুরআন তিলাওয়াত করা যেমন একটি পুণ্যময় ইবাদত, তেমনি এর প্রতিটি হরফ পাঠের জন্য রয়েছে অফুরন্ত সাওয়াব ও ফযীলত। তবে এই তিলাওয়াত হতে হবে ছহীহ ও তাজবীদ অনুযায়ী—যেমনটি কুরআন নাযিল হয়েছে এবং নবী করীম ﷺ নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, ভুল উচ্চারণে তিলাওয়াত অর্থ বিকৃতি ঘটাতে পারে, যা হতে পারে গোনাহের কারণ।
এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন তিলাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি, তাজবীদের গুরুত্ব, হাদীসে বর্ণিত ফযীলত এবং তিলাওয়াতকারীর মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনা করব। যারা কুরআনের হক আদায় করতে চান, তাদের জন্য এই আলোচনাটি হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনুপ্রেরণাদায়ক।
১. তাজবীদের গুরুত্ব: কুরআন তিলাওয়াতে শুদ্ধতার অপরিহার্যতা
ছহীহভাবে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيْلًا
“তোমরা তারতীল (তাজবীদ সহকারে) কুরআন তিলাওয়াত কর"। (মুযযাম্মিল: ২)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কুরআনের উচ্চারণে ধীরস্থিরতা, শুদ্ধতা এবং ভাবগম্ভীরতা অপরিহার্য। তাজবীদ অনুযায়ী না পড়লে অনেক সময় অর্থ বিকৃত হয়ে যায়, যা গুনাহের কারণ হতে পারে। তাই কুরআনের হক আদায়ের প্রথম শর্তই হলো ছহীহ তাজবীদ শেখা ও তা অনুসরণ করে তিলাওয়াত করা।
২. আল্লাহর নির্দেশ: কুরআন তারতীল সহকারে তিলাওয়াত করো
অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন - اَلَّذِيْنَ اٰتَيْنٰهُمُ الْكِتٰبَ يَتْلُوْنَهٗ حَقَّ تِلَاوَتِهٖ
অর্থ: যাদের আমি কিতাব প্রদান করেছি, তারা তা যেন তিলাওয়াতের হক আদায় করে পাঠ করে (তিলাওয়াতের হক বলতে তাজবীদ সহকারে পাঠ করা) (সুরা বাকারা: ১২১)
৩. হাদীসে কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত ও সতর্কবাণী
তাজবীদ অনুযায়ী ছহীহ্ করে কুরআন না পড়লে আয়াতের অর্থ পরিবর্তন ও বিকৃত হয়ে যেতে পারে। বিশুদ্ধ তিলাওয়াত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কয়েকটি হাদীছ-
رُبَّ قَارِـئٍ لِلْقُرْاٰنِ وَالْقُرْاٰنُ يَلْعَنُهٰٗ
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, তিলাওয়াত করতে হলেও শুদ্ধভাবে করতে হবে। অন্যথায় তা নেকীর বদলে গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার রাসূলুল্লাহ ﷺ আরও বলেন:
অর্থ: কুরআন শরীফের এমন বহু পাঠক আছে, যারা কুরআন তিলাওয়াত করে অথচ অশুদ্ধ পড়ার কারণে কুরআন তাদেরকে লা'নত করে। (تاريخ النشر: 17/ربيع الآخر/1444)
إِنَّ اللّٰهَ يَرْفَعُ بِهٰذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهٖ اٰخَرِيْنَ
অর্থ: আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদের দ্বারা অনেক লোককে সম্মান বৃদ্ধি করেন। আর অনেক লোককে অপমানিত করেন। (সহীহ মুসলিম: ১৭৮২)
৪. সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াতের মর্যাদা
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَّمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ وَزَادَ غَيْرُهٗ يَجْهَرُ بِهٖ
অর্থ: আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক সুন্দর আওয়াজে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের নয়। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) ব্যতীত অন্যরা يَجْهَرُ بِهِ ’উচ্চস্বরে কুরআন পড়ে না’ কথাটুকু বৃদ্ধি করেছেন। (সহীহ বুখারী:৭৫২৭)
حَسِّنُوْا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيْدُ الْقُرْآنَ حَسَنًا.
অর্থ: তোমাদের (সুমধুর) আওয়ায দ্বারা কুরআনকে সুন্দর কর। কেননা, সুমধুর কণ্ঠস্বর কুরআনের সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে দেয়।” (সুনান আদ দারিমী: ৩৫৪০)
৫. কুরআন শেখা ও শেখানোর সর্বোচ্চ ফযীলত
خَيْرُكُمْ مَّنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهٗ
অর্থ: তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে নিজে কুরআন শিক্ষা লাভ করে এবং অপরকে তা শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী: ৫০৫৭, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)
أَفْضَلُ الْعِبَادَةِ تِلَاوَةُ الْقُرْآنِ أَفْضَلُ الذِّكْرِ تِلَاوَةُ الْقُرْاٰنِ فِي الصَّلَاةِ ثُمَّ تِلَاوَةِ الْقُرْاٰنِ فِيْ غَيْرِ الصَّلَاةِ ثُمَّ الصَّوْمِ ثُمَّ الذِّكْرِ ("شرحه على صحيح البخاري" 10/ 267، ط. مكتبة الرشد)
“সর্বোত্তম যিকর সালাতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত, এরপর সালাতের বাইরে কুরআন তিলাওয়াত। এরপর সিয়াম। এরপরে অন্যান্য যিকর।” (রাহে বেলায়েত)
তিলাওয়াতকারীর মর্যাদা ও প্রতিদান সম্পর্কে হাদীছে এসেছে-
اَقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ اخِرَايَةٍ تَقْرَأَهَا
অর্থ: কুরআনের অধিকারীকে বলা হবে, কুরআন পড়ে যাও আর ধীরস্থিরভাবে তারতীলের সঙ্গে পাঠ করো যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সঙ্গে পড়ে থাকতে। কেননা তোমার অবস্থান সেখানেই যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হবে। (তিরমিযী: হাদীস নং-২৯১৪)
তিলাওয়াতে সুর ও আওয়ায অনুকরণ সম্পর্কে হাদীছ-
اَقْرَأُوُا الْقُرْآنَ بِلْحُوْنِ الْعَرَبِ وَأَصْوَاتِهَا
"কুরআন তিলাওয়াত করো আরবদের সুর এবং আওয়ায অনুকরণে।" (মিশকাতুল: ২২২৭)
হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ أَنْ يُقْرَأُ الْقُرْآنُ كَمَا أُنْزِلَ
অর্থ: আল্লাহপাক কুরআন মাজীদকে যেভাবে নাযিল করেছেন, সেভাবে পড়াকে পছন্দ করেন। (ইবনে খুযাইমা)
৬ . প্রত্যেক হরফে দশ নেকী ও কুরআন বাহকের সম্মান
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِّنْ كِتَابِ اللّٰهِ فَلَهٗ بِهٖ حَسَنَةٌ وَّالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُوْلُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيْمٌ حَرْفٌ "
অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার নেকী হবে। আর নেকী হয় দশ গুণ হিসাবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম মিলে একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, এবং মীম আরেকটি হরফ। (তিরমিযি: ২৯১০)
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- أَشْرَفُ أُمَّتِي حَمْلَةُ الْقُرْاٰنِ - আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ও বুযুর্গ ঐ ব্যক্তি, যে কুরআন মাজীদ বহন করে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ছহীহভাবে ক্বোরআন মাজীদ তিলাওয়াত এবং ক্বোরআনী নির্দেশ মুতাবেক জীবন-যাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
What's Your Reaction?






