ছিফাতের বিবরণ: কুরআন তেলাওয়াতের সৌন্দর্য

এই নিবন্ধে আমরা কুরআন তেলাওয়াতের ছিফাতের বিবরণ বর্ণনা প্রদান করছি। তেলাওয়াতের সৌন্দর্য এবং সঠিক নিয়মাবলি সম্পর্কে জানুন, যা আপনার তেলাওয়াতকে আরো সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করে তুলবে

Oct 24, 2024 - 20:46
Oct 25, 2024 - 17:41
 0  9
ছিফাতের বিবরণ: কুরআন তেলাওয়াতের সৌন্দর্য

ছিফাতের বিবরণ (সিফাত) সম্পর্কে বিস্তারিত:

ছিফাতের সংজ্ঞা ও সাধারণ ধারণা:

صِفَات (ছিফাত) অর্থ গুণ, অবস্থা বা স্বভাব। যে অবস্থা বা নিয়মের সাথে হারফ তাহার নিজ মাখরাজ হইতে উচ্চারিত হয়, সেই অবস্থা বা নিয়ম-কানুনকে ছিফাত বলা হয়। যেমন, কোনো হারফ শক্ত, কোনো হারফ নরম, কোনো হারফ উচ্চারণের সময় আওয়াজ মোটা হয়, কোনো হারফ উচ্চারণে শ্বাস চালু থাকে ইত্যাদি। এই সকল অবস্থাকেই ছিফাত বলা হয়। উল্লেখ্য, প্রতিটি হারফের একাধিক ছিফাত আছে, কিন্তু একটি হারফের একটি মাত্র মাখরাজ থাকে। এক মাখরাজ হইতে একাধিক হারফ উচ্চারিত হইতে পারে। তাই নির্দিষ্ট মাখরাজ ও ছিফাত দ্বারা একটি হারফকে অন্য আর একটি হারফ হইতে সহজেই পৃথক করা যায়। যেমন, ص س এর মাখরাজ এক হইলেও ছিফাত দ্বারা উহাদিগকে পৃথক করা যায়। ص  এর উচ্চারণ মোটা হইবে আর س  এর উচ্চারণ চিকন হইবে।

আরবিতে মোট ২৯টি হারফ, ১৭টি মাখরাজ এবং ১৮টি আবশ্যক ছিফাত রয়েছে।

ছিফাতের প্রকারভেদ:

ছিফাত প্রধানত দুই প্রকার:

صِفَات لَازِمَة (ছিফাতে লাঝিমাহ): এটি বাধ্যতামূলক ছিফাত, যা হারফের স্বভাবগত গুণ।

صِفَات عَارِضِيَّة (ছিফাতে আরিদ্বিয়্যাহ): এটি অস্থায়ী ছিফাত, যা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দেখা যায়।

১. لَازِمَة صِفَات (ছিফাতে লাঝিমাহ)

لَازِم (লাঝিমাহ) অর্থ আবশ্যকীয়, বাধ্যতামূলক। এই বাধ্যতামূলক ও স্বভাবগত গুণ হারফ হইতে কোন সময়ই আলাদা হইতে পারে না। যদি পৃথক হয় বা তিলাওয়াতের সময় যথাযথভাবে গুণাবলী আদায় না হয়, তাহা হইলে হারফটির বাস্তব রূপই নষ্ট হইয়া যায় এবং এক হারফ অন্য হারফে পরিণত হইয়া উচ্চারণ অশুদ্ধ হইয়া যায়। যেমন, ص উচ্চারণে ইতবাক্ব ছিফাতটি আদায় না হইলে س হারফে পরিণত হয়।

এই ছিফাতটিকে নিম্নলিখিত তিনটি নামেও ডাকা হয়:

  • صِفَات ذَاتِيَّة (ছিফাতে যাতিয়‍্যাহ)
  • صِفَات مُمَيَّزَة (ছিফাতে মুমাইয়িযাহ)
  • صِفَاتِ مُقَوِّمَة (ছিফাতে মুক্বাওয়িমাহ)

ছিফাতে লাঝিমাহ প্রধানত দুই প্রকার:

  • صِفَاتِ لَازِمَةِ مُتَضَادَّة (ছফাতে লাঝিমাহ মুতাদ্বদ্দাহ)
  • صِفَاتِ لَازِمَةِ غَيْرِ مُتَضَادَّة (ছিফাতে লাঝিমাহ গইরি মুতাদ্বদ্দাহ)

২. لَازِمَةِ  مُتَضَادَّة  صِفَاتِ (বিপরীতমুখী স্বভাব)

مُتَضَادَّة (মুতাদ্বদ্দাহ) অর্থ বিপরীতমুখী, অর্থাৎ একটি অপরটির বিপরীত। ছিফাতে মুতাদ্বদ্দাহ (বিপরীতমুখী স্বভাব) এর প্রতিটি ছিফাত বা গুণের বিপরীত স্বভাব রহিয়াছে। যতগুলি হারফ এক ছিফাতে পাওয়া যাইবে, অবশিষ্ট হারফগুলি উহার বিপরীত ছিফাতে অবস্থান করিবে। ছিফাতে মুতাদ্বদ্দাহ ৫টি জোড়ায় মোট ১১টি স্বভাবে বিভক্ত যাহা একটি অপরটির বিপরীত। যেমন:

 

এক পক্ষ

 

বিপরীত পক্ষ

১ম জোড়া

هَمْس (হামস)

جَهْر (জাহর)

২য় জোড়া

شِدَّة (শিদ্দাহ)

توسط (তাওয়াসুত)

رِخْوَة (রিখওয়াহ)

৩য় জোড়া

اِسْتِعْلَاء (ইস্তি'লা)

 

اِسْتِفَال (ইস্তিফাল)

৪র্থ জোড়া

اِطْبَاق (ইত্ববাক্ব)

إِنْفِتَاح (ইংফিতাহ)

৫ম জোড়া

إِذْلَاق (ইযলাক্ব)

إِصْمَات (ইছমাত)

ছিফাতগুলির ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ

১ম জোড়াঃ

(ক) হামস (هَمْس):
হামস শব্দের অর্থ ক্ষীণ আওয়াজ বা অস্পষ্ট শব্দ। এই স্বভাবের হারফগুলো উচ্চারণে আওয়াজ মাখরাজে গিয়ে নরমভাবে থামলেও শ্বাস জারি থাকে। ফলে, আওয়াজ ক্ষীণ ও দুর্বল হয়। যে সমস্ত হারফে এই স্বভাব পাওয়া যায়, সেই হারফগুলোকে مَهْمُؤسَة (মাহমূসাহ) বলা হয়। এরা মোট ১০টি, যথা:
ت ث ح خ س ش ص ف ك ه
মনে রাখার সুবিধার্থে একটি বাক্য: فَحَثَّهٗ شَخْصٌ سَكَتْ

(খ) জাহর (جَهْر):
জাহর শব্দের অর্থ উচ্চ আওয়াজ বা সশব্দতা। এই স্বভাবের হারফগুলো উচ্চারণে আওয়াজ মাখরাজের মধ্যে শক্তভাবে থেমে যায় এবং শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এতে আওয়াজে শক্তি ও উচ্চতা সৃষ্টি হয়। এটি হামসের বিপরীত। যে সমস্ত হারফে এই স্বভাব পাওয়া যায়, সেই হারফগুলোকে مَجْهُورَةٌ (মাজহুরহ) বলা হয়। এরা বাকী ১৯টি, যথা:
ا ب ج د ذ ر ز ض ط ظ ع غ ق ل م ن و ء ي

২য় জোড়াঃ

(ক) شِدَّة (শিদ্দাহ): এর অর্থ শক্ত, কঠোর। এই হারফগুলির উচ্চারণে আওয়াজ মাখরাজে গিয়ে এমন কঠিনভাবে থেমে যায় যে, আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে আওয়াজের মধ্যে কঠোরতা সৃষ্টি হয়। এই হারফগুলিতে সাকিন ও ইদগম অবস্থায় আওয়াজ নিজ মাখরাজের মধ্যে কঠিনভাবে বন্ধ হওয়ার কারণে শ্বাস জারি থাকে না এবং আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। যে সমস্ত হারফে এই স্বভাব পাওয়া যায়, সেই হারফগুলিকে شَدِيْدَة (শাদীদাহ) বা মহাপ্রাণ বর্ণ বলা হয়। এরা মোট ৮টি। যথা:

ء  ت ك د ج ب ط ق

 
মনে রাখার সুবিধার্থে:   أَجِدُ قَطُّ بَكَتْ      

(খ) رِخْوَة (রিখয়াহ): এর অর্থ নরম, নমনীয়। এই হারফগুলির উচ্চারণে আওয়াজ নরমভাবে হয় এবং শ্বাস চালু থাকে। আওয়াজের এই নরমতা রিওয়াহ বা অল্পপ্রাণ বর্ণ হিসেবে পরিচিত। হাসের বিপরীত যেমন জাহর, তেমনি শিদ্দাহর বিপরীত রিওয়াহ। এই হারফগুলিকে رِخْوَات (রিখওয়াত) বলা হয়। এরা মোট ১৬টি। যথা:  ا ث ح خ ذ ز س ش ص ض ظ غ ف و ه ي 


   উল্লেখ্য, এই ছিফাতের আলিফ হারফটি হারকাতবিহীন মাদের আলিফ, (হামযাহ) নয়। হামযাহ হলে শিদ্দাহ হবে।

শিদ্দাহ ও রিখওয়াহ এই দুইটি ছিফাতের মাঝে আরেকটি ছিফাত আছে, যাহাকে تَوَسُّط (তাওয়াসুত্ব) বলা হয়।

(গ) تَوَسُّط (তাওয়াসুত্ব): এর অর্থ মধ্যম অবস্থা। উচ্চারণে আওয়াজ মাজের মধ্যে মধ্যম অবস্থায় (না শক্ত, না নরম) থাকে; নিঃশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হয় না আবার পুরোপুরি চালুও থাকে না। এই হারফগুলিকে   مَتَوَسِّطة (মুতাওয়াসিত্বহ) বা مَبِّنّة (মুবাইয়িনাহ) বা অন্তঃস্থ বর্ণ বলা হয়। এরা বাকী ৫টি। যথা:
ل ر ن ع  م  

মনে রাখার সুবিধার্থে: لَنْ عُمَرُ 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ  

(ক)  (تَوَسُّط) তাওয়াসুত ছিফাতের মধ্যে কিছুটা শিদ্দাহ এবং কিছুটা রিওয়াহ ছিফাত পাওয়া যায়, তাই কিছু তাজবীদের কিতাবে এই ছিফাতকে পৃথক কোন ছিফাত হিসাবে গণ্য করা হয়নি। সেক্ষেত্রে ছিফাতে মুতাদ্বদ্দাহ ১০টি হয়ে মোট ছিফাত ১৭টি হয়। আবার কিছু কিতাবে এটিকে আলাদা ছিফাত হিসাবে গণ্য করা হয়, ফলে মোট ছিফাত ১৮টি হয়ে যায়। এই কিতাবে এটিকে আলাদা ছিফাত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

(খ) ت ও ك এই দুইটি হারফকে হামস ছিফাতে গণ্য করা হয়েছে, অথচ তাদের উচ্চারণের সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। আবার শিদ্দাহ ছিফাতের অন্তর্ভুক্তও করা হয়েছে, কারণ হারফ দুইটির মধ্যে হামসের গুণ কম এবং শিদ্দাহর গুণ বেশি থাকার কারণে উচ্চারণের সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য তাদের শিদ্দাহ ছিফাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হামস ছিফাত থাকায় উচ্চারণে আওয়াজ বন্ধ হলেও কিছুটা চালু থাকে; তাই শ্বাস চালু থাকার সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন আওয়াজ পুরোপুরি চালু না হয়। পুরোপুরি চালু হলে উক্ত হারফ দুইটির মধ্যে শিদ্দাহ ছিফাত থাকবে না বরং রিখওয়াহ হয়ে যাবে, ফলে উচ্চারণ ভুল হবে।

৩য় জোড়াঃ

(ক) اِسْتِعْلَاء (ইস্তিয়'লা)
অর্থ: উপরে উঠা, উচ্চ হওয়া। এই হারফগুলি উচ্চারণের সময় জিহ্বার প্রায় অংশ (গোড়া) উপরের তালুর দিকে উঠিয়া যায়, ফলে উচ্চারণের সময় আওয়াজ পোর বা মোটা হয়। এই হারফগুলিকে مُسْتَعْلِيَة (মুস্তালিয়াহ) বা তালব্য বর্ণ বলা হয়। ইহারা ৭টি। যথা:
خ ص ض ط ظ ع ق
মনে রাখার সুবিধার্থে: خُصَّ ضَغْطٍ قَظْ
উল্লেখ্য, এই হারফগুলির উচ্চারণ সর্বদা মোটা হবে। যেমন:

যেমন, -ص ছ্ব (ছ্ব-দ যবর ছ, ছা নয়,) قَ -ক্ব (ক্ব-ফ যবর ক্ব, ক্বা নয়) ইত্যাদি।

(খ) اِسْتِفَال (ইস্তিফাল)

অর্থ: নিচে যাওয়া। এই হারফগুলি উচ্চারণের সময় জিহ্বার অধিকাংশ অংশ তালুর দিকে না উঠিয়া নিচের দিকে ঝুঁকিয়া যায়। ফলে আওয়াজ বারিক বা চিকন স্বরে হয়। এই হারফগুলিকে مُسْتَفِلَة (মুস্তাফিলাহ) বলা হয়। এই ছিফাতটি اِسْتِعْلَاء ছিফাতের বিপরীত। বাকী ২২টি হারফ এই সিফাতের। যথা:
ا ب ت ث ج ح د ر ز م ش ع ف ك ل ن و ء ه ى

৪র্থ জোড়াঃ

(ক) اِطْبَاق (ইত্ববাব্ক্ব)
অর্থ: ঢেকে দেওয়া, আবৃত করা। এই হারফগুলি উচ্চারণকালে জিহ্বার প্রায় অংশ উপরের তালুর সাথে মিলিয়া তালুকে ঢাকিয়া রাখে। এই হারফগুলিকে مُطْبَقَة (মুত্ববাক্ব) বা তালব্য বর্ণ বলা হয়। ইহারা ৪টি। যথা:
ص ض ط ظ

(খ) اِنْفَتَاح (ইনফিতাহ)
অর্থ: খোলা থাকা, পৃথক থাকা। এই হারফগুলি উচ্চারণের সময় জিহ্বার মধ্যখান উপরের তালু হইতে পৃথক থাকে। এই ছিফাতটি اِطْبَاق ছিফাতের বিপরীত। এই হারফগুলিকে مُنْفِتِحَة (মুনফাতিহাহ) বলা হয়। ইহারা বাকী ২৫টি। যথা:
ا ب ت ث ج ح خ د ذ ر ز س ش ع غ ف ق ك ل م ن و ء ه ى

৫ম জোড়াঃ

(ক) اِذْلَاق (ইযলাক)
অর্থ: জিহ্বার কিনারা হইতে বাহির হওয়া। ذَلْقُ (জালকু) অর্থ: জিহবার অগ্রভাগ। এই হারফগুলি জিহ্বার কিনারা ও ঠোঁট হইতে সহজে ও তাড়াতাড়ি উচ্চারিত হয়। এই হারফগুলিকে مُذْلِقَة (মুযলিককাহ) বা স্পর্শ বর্ণ বলা হয়। ইহারা ৬টি। যথা:
ر ل ن ب ف م
তবে ر, ل, ن এই তিনটি হারফ জিহ্বার আগা বা কিনারা হইতে এবং ب, ف, م ঠোঁটের প্রান্ত হইতে উচ্চারিত হয়।
মনে রাখিবার সুবিধার্থে:  لُبِّ  مِنْ  فَرَّ

(খ) اِصْمَات (ইছমাত)
অর্থ: চুপ করানো। এই হারফগুলি উচ্চারণকালে নিজ মাখরাজে মজবুতভাবে ও দৃঢ়তার সাথে চুপ হয়ে যায়, উচ্চারণ তাড়াতাড়ি ও সহজে আদায় হয় না। ইহারা ঠোঁট ও জিহ্বার কিনারা হইতেও উচ্চারিত হয় না। এই ছিফাতটি اِذْلَاق ছিফাতের বিপরীত। এই হারফগুলিকে مُصْمِتَة (মুছমিতাহ) বলা হয়। ইহারা বাকী ২৩টি। যথা:
ا ت ث ج ح خ د ذ ز س ش ص ض ط ظ ع غ ق ك و ء ه ى

صِفَاتِ لَازِمَةِ غَيْرِ مُتَصَادَّة (বিপরীতমুখীহীন ছিফাত)

হারফের যে সব ছিফাত পরস্পর বিরোধী নয় অর্থাৎ ইহাদের স্বভাবের বিপরীত বা মুকাবিল কোন ছিফাত নাই। এই ধরনের ছিফাতকে صفات لَأَرْمَةَ غَيْرِ مُتَضَادَّة (ছিফাতি লাঝিমাহ গইরি মুতাদ্বদ্দাহ) বা বিপরীতমুখীহীন ছিফাত বলে। ইহাকে صِفَاتِ لَازِمَةِ مُنْفَرِدَةَ (ছিফাতি লাঝিমাহ মুংফারিদাহ) ও বলে। مُنْفَرِدَة অর্থ পৃথক, স্বতন্ত্র, একাকী। ইহাদের বিপরীত কোন ছিফাত না থাকিবার কারণে এই নামে অভিহিত করা হয়। এইরূপ ছিফাত ৭টি। যথা,

ক. صَفِيْرَة )ছফীরহ(

খ. قَلْقَلَة )কলকলাহ(

গ. تَكْرَار ) তাকরার (

ঘ. تَفَشِّیْ )তাফাশী(

. إِنْحِرَاف )ইনহিরফ(

চ. إِسْتِطَالَة )ইস্তিত্বলাহ(

ছ. لِيْن )লীন(

নিম্নে ইহাদের বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হইল।

. صَفِيْرَة (ছফীরহ):

ছফীরহ অর্থ শিস, বাঁশির আওয়াজ। এই ছিফাতের হারগুলি উচ্চারণের সময় ছানায়া উল্ইয়া ও ছানায়া সুফলা এই চার দাঁতের মধ্যস্থল হইতে শক্তভাবে চড়ুই পাখির আওয়াজের ন্যায় এক প্রকার আওয়াজ বা বাঁশির আওয়াজের ন্যায় তীক্ষ্ম আওয়াজ বাহির হয়। তাই এই হারফগুলিকে صَفِيْرَة )ছফীরহ) বা উষ্ম বর্ণ বলে। ইহারা ৩টি। যথাص س ز

.  قَلْقَلَة  )ক্বলক্বলাহ ):

ক্বলক্বলাহ অর্থ ধাক্কা দেওয়া, নাড়া দেওয়া, প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করা। ক্বলক্বলাহ হা ৫টি, যথা- قطب جد এই ছিফাতের হারগুলি যখন সাকিন হয় তখন ইহাদের মাখরাজের মধ্যে জোরে ধাক্কা লাগাইয়া প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করিয়া গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করিতে হয়। আর এই ধাক্কা লাগানোর কারণে এক প্রকার অতিরিক্ত আওয়াজ প্রতিধ্বনির মত মাখরাজ হইতে বাহির হয়। ইহাকে ক্বলক্বলাহ বলে। এই হারগুলি একবার উচ্চারিত হইয়া আবার উচ্চারিত হইতে চায় অর্থাৎ পুনরায় উহার প্রতিধ্বনি হইতে চায়। তাই ইহাদের পাঠকালে অছল অবস্থা (বাক্যের মধ্যে মিলাইয়া পড়ার সময়) হইতে ওয়াক্ফ অবস্থায় (দম ফেলানোর সময়) বেশি সতর্কতার সহিত ক্বলক্বলাহ করিতে হয়। তবে শব্দের মাঝে ক্বলক্বলাহ কম হইবে, বাক্যের মধ্যে ও শব্দের শেষে মধ্যম রকম এবং বাক্যের শেষে ও শব্দের শেষে সর্বোচ্চ কুজ্জ্বলাহ করিতে হইবে। আবার অপর ৪টি হারফ অপেক্ষা ق-এর মধ্যে ক্বলক্বলাহ বেশি করিতে হয়। ক্বলক্বলাহ আদায়কালে যেন কোন প্রকার হারকাত (যবর, যের বা পেশ) প্রকাশ না পায়। তবে মাখরাজের মধ্যে ক্বলক্বলাহ কারণে যবরের দিকে সামান্য ঝোঁক থাকিবে। পরিপূর্ণ যবর যেন না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকিতে হইবে। যেমন, ৩০ পারা সূরা বালাদ, আয়াত-


১নং তীর চিহ্নিত স্থানে ক্বলক্বলাহ করতে হবে। একইভাবে ২নং তীর চিহ্নিত স্থানেও ক্বলক্বলাহ করতে হবে। তবে ১নং স্থানের চেয়ে এই স্থানে বেশি ক্বলক্বলাহ করতে হবে, কারণ ق -এর মধ্যে ছিফাতে ক্বলক্বলাহ অন্যান্য ৪টি হাফের চেয়ে বেশি হয়।

৩নং তীর চিহ্নিত স্থানে দম ফেললে ক্বলক্বলাহ হবে। তবে এই দম ফেলানোর কারণে অতি স্পষ্টভাবে ক্বলক্বলাহ আদায় করতে হবে। আর দম না ফেলে মিলিয়ে পড়লে ক্বলক্বলাহ হবে না।

ওয়াফ্ফের সময় তাশদীদ হলে উচ্চারণের সময় আরও অধিক সময় নিয়ে ক্বলক্বলাহ করতে হয়। তা না হলে তাশদীদযুক্ত (মুছাক্কল) হাফ তাশদীদবিহীন (মুখফাফ) হারফ হয়ে ভুল উচ্চারণ হবে। যেমন, ৩০ পারা সূরা লাহাব, আয়াত ১ ও ২

৩০ পারা সূরা আছর আয়াত ২

তীর চিহ্নিত তাশদীদযুক্ত ক্বলক্বলাহ হারফে দম ফেলিলে উচ্চারণে একটি হারফে দুইটি হারফের সময় লাগাইয়া ক্বলক্বলাহ করতে হয়। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন তাশদীদযুক্ত হারফ সাকিনযুক্ত হারফের মত উচ্চারিত না হয়। যেমন:

تَبَّ ছিল تَبْبَদম ফেলিলে হবে تَبْبْ
حَقَّ ছিল حَقْقِদম ফেলিলে হবে حَقْقْ

দম ফেলিবার কারণে একই হারফ পাশাপাশি দুইবার সাকিন হয়ে যায়। তাই উচ্চারণে দীর্ঘ সময় ধরে ক্বলক্বলাহ না করলে ভুল উচ্চারণ হবে। এক্ষেত্রে কোনো অভিজ্ঞ উস্তাদের সাহায্য নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

গ. تَكْــــرَار (তাকরার):
তাকরার অর্থ হলো বারবার হওয়া বা পুনরাবৃত্তি ঘটানো। হারফে তাকরার মাত্র ১টি। যথা, (র)। এই হারফটি সাকিন, তাশদীদ বা ওয়াক্ত অবস্থায় এমনভাবে জিহ্বা কাঁপিতে থাকে যে, হারফটি বারবার উচ্চারিত হতে চায়। বারবার উচ্চারিত না হয়ে যেন একবারই উচ্চারিত হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন,
اَرْحَمُ এর উচ্চারণ যেন اَرْرْحَمُ না হয়। র-এর উপর তাশদীদ থাকলে উচ্চারণকালে তাকরার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এই সময়ে খুব বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন,
الرَّحْمَنُ - الرَّحِيمِ - الرِّجَالُ - مُسْتَقَرُّ - فِي الْحَرُ

ঘ. تَفَشِّى (তাফাশী):
তাফাশী অর্থ হলো ছড়িয়ে পড়া বা ছড়িয়ে যাওয়া। হারফ উচ্চারণকালে আওয়াজ মুখের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং জিহ্বার আগা পর্যন্ত আসে, বলেই এটাকে تَفَشِّى (উষ্ম বর্ণ) বলা হয়। এর হারফ ১টি। যথা, ش
লক্ষ্য রাখতে হবে যে, উচ্চারণের সময় আওয়াজ উপরে উঠে যেন পোর না হয়ে যায়। যেমন,
شَهْرٌ - مَشْهُورٌ - أَشْهَدُ

৫. اِنْحِرَافٌ (ইনহিরফ):
ইনহিরফ অর্থ হলো ভিন্নপথে গমন বা বিচ্যুতি। হারফ উচ্চারণের সময় জিহ্বা হারফটির নিজ মাখরাজ ছাড়িয়ে অন্য হারফের মাখরাজের দিকে ঝুঁকিয়ে যায়, এমন অবস্থাকে ইনহিরফ বলা হয়। এর হারফ ২টি, যথা, ر এবং لএই হারফ দুটিকে مُنْحَرِفَةٌ (মুনহারিফাহ) বলা হয়। ল ও র উভয়ই নিকটবর্তী মাখরাজবিশিষ্ট হারফ, তাই ল উচ্চারণের সময় জিহ্বার আগা র-এর মাখরাজের দিকে ঝুঁকিয়ে যায়। আবার, র উচ্চারণের সময় জিহ্বার আগা ল-এর মাখরাজের দিকে অগ্রসর হতে চায়। হারকাতের তুলনায় সাকিন ও তাশদীদে বেশি ফিরতে চায়। তাই তিলাওয়াতের সময় বেশ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যেমন,
اَلرِّجَالُ হতে চায় اَللَّجَالُ (ভুল উচ্চারণ)
اللَّطِيفُ হতে চায় الرَّطِيفُ (ভুল উচ্চারণ)
এই হারফ দুটি বাদে বাকী ২৭টি হারফকে حُرُوْف ثَابِت (হুরুফে ছাবিত) বলা হয়। কারণ, তারা আপন আপন মাখরাজে ঠিক থাকে।

চ. إِسْتِطَالَة (ইস্তিত্বলাহ):
ইস্তিত্বলাহ্ অর্থ হলো দীর্ঘ হওয়া বা লম্বা হওয়া। এর হারফ ১টি। যথা, ض, এটাকে হারফ مُسْتَطِيلَة (মুস্তাত্বিলাহ্) বলা হয়।
ض হারফের উচ্চারণের সময় জিহ্বার কিনারা মাখরাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধীর গতিতে চলে। ফলে মাখরাজে আওয়াজ দীর্ঘ হয়। এই সময় نَوَاجِذْ (নাওয়াজিয) দাঁতের মাড়ি থেকে ضَاحِكَ (দ্বহিক) দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত পূর্ণভাবে জিহ্বার কিনারা স্পর্শ করে। যেমন, صَالَّيْن
উচ্চারণের সময় ض হারফের আওয়াজ একসাথে বাহির না হয়ে বরং ধীরে ধীরে বাহির হবে। ফলে এটি মাদের মতো শোনা যায়। হারফে মুস্তাত্বিলাহর আওয়াজ লম্বা হওয়া ও মাদের মধ্যে পার্থক্য হলো- হারফে মুস্তাত্বিলাহর আওয়াজ মাখরাজের মধ্যে দীর্ঘ হয় এবং মাদের হারফের আওয়াজ হাওয়ার মধ্যে দীর্ঘ হয়। উল্লেখ্য, ض এর উপর হারকাত, সাকিন, তাশদীদ যা-ই থাকুক না কেন, সর্বাবস্থায় এটি মুস্তাত্বিলাহ হবে।

ছ. لِيْن (লীন):
লীন অর্থ হলো নরম বা নমনীয়। সাকিনের পূর্বে যবর এবং ৬ সাকিনের পূর্বে যবর থাকলে ঐ এবং ৬-কে হাফে লীন বলা হয়। অতএব, লীনের হারফ দুটি। যথা, ৩ এবং ৬, তিলাওয়াতের সময় লীনের হারফ বিনা কষ্টে এমন নরমভাবে আদায় করতে হয় যেন মাদ করতে চাইলে মাদ হয়ে যায়। লীনের হারফের পরে দম ফেললে মাদ্দে লীন হয়। আর দম না ফেললে মাদ হবে না, অর্থাৎ টানতে হবে না। যেমন,
خَوْفٌ - بَيْتٌ - صَيْفِ
কিছু কিছু তাজবীদের কিতাবে صِفَاتِ لِيْن (ছিফাতে লীন) এর পরিবর্তে صِفَاتِ غُنَّة (ছিফাতে গুন্নাহ) এর বর্ণনা করা হয়েছে।

 

. ছিফাতে আরিদ্বিয়‍্যাহ (صِفَات عَارِضِيَّة)

 

عَارِضِيَّة  মানে সাময়িক বা অস্থায়ী। এই صِفَا ت (attributes) আদায় না হলে হারফের বাস্তব রূপ ঠিক থাকে, কিন্তু এর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। এই ছিফাত ن م ر ل ا و ء ي  এই আটটি হাফের মধ্যে বিভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়।

মনে রাখার সুবিধার্থে: اَوْ يَرْمَلَانْ

এই হারফগুলির অশুদ্ধ উচ্চারণ সম্বন্ধে নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হল:

ক. ইখফার স্থলে গুন্নাহসহ ইখফাই করা উচিত।
খ. ر (র) হারফের পূর্বে যবর বা পেশ আসলে মোটা বা পোর করে পড়া উচিত।
গ. একইভাবে الله শব্দের লামের পূর্বে যবর বা পেশ আসলে লামকে মোটা বা পোর করে পড়া উচিত।

এই সকল স্থানে তাজবীদের নিয়ম না মানলে তেলাওয়াতের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয় তিলাওয়াতের এই ভুলকে لَحْنِ خَفِی )লাহানে খফী( বলে। ইহা হতে বাঁচিয়া থাকা একান্ত প্রয়োজন। ছিফাতটিকে صِفَاتِ مُحَسَّنَة )ছিফাতে মুহাসনাহ(, صِفات مُزيّنة )ছিফাতে মুযাইয়্যিনাহ) বা صِفَات مُحَلِّيَّة )ছিফাতে মুহাললিয়‍্যাহ) বলে

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow