"তারতীল ও লাহনের বিবরণ: কুরআন পাঠের সঠিক পদ্ধতি ও সুর"
তারতীল ও লাহনের বিবরণ: কুরআন পাঠের সঠিক পদ্ধতি ও সুর। জানুন তারতীল ও লাহনের মধ্যে পার্থক্য, কিভাবে সঠিকভাবে কুরআন পাঠ করতে হয় এবং কেন সুরেলা কণ্ঠে পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ।
তারতীল ও লাহনের বিবরণ
আরবী ধ্বনিতত্ত্ব বিদ্যায় تَجْوِیْدٌ (তাজবীদ) হইতেছে প্রতিটি হারফকে তাহার নির্দিষ্ট مَخْرَجْ )মাঘ্রজ) বা উচ্চারণস্থল হইতে সকল صِفَاتْ (ছিফাত) বা গুণাবলী (ছিফাতে লাঝিমাহ ও ছিফাতে মুহাসিনাহ)সহ সহজে ও বিশুদ্ধভাবে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা। তাজবীদের বিপরীতে তিলাওয়াত কঠোরভাবে নিষেধ। কুরআন শারীফ বিশুদ্ধভাবে তাজবীদসহকারে তিলাওয়াত করা ফরযে আঈন (অপরিহার্য)। তাই যে ব্যক্তি কুরআন শারীফ তিলাওয়াত করিবে তাহার উপর তাজবীদ শিক্ষা করা বাধ্যতামূলক। অশুদ্ধ তিলাওয়াতের দ্বারা নামাজ আদায় করা হইলে সেই নামাজও শুদ্ধ হইবে না। হাদীছ শারীফে তাজবীদসহকারে তিলাওয়াতের জন্য যেমন পুরস্কারের ঘোষণা রহিয়াছে, তেমনি অশুদ্ধ তিলাওয়াতের শাস্তির কথাও উল্লেখ আছে। তাজবীদ বিশেষজ্ঞ ইমাম জাযরী (রহমাতুল্লহ আলাইহি) বলিয়াছেন,
وَالْأَخْذُ بِالتَّجْوِيْدِ حَتْمٌ لَّأَزِمْ
مَنْ لَمْ يُجَوِّدِ القُرْآنَ آثِم
তাজবীদের সহিত তিলাওয়াত করা অতি জরুরী!
তাজবীদ ছাড়া কুরআন পড়া হবে গুনাহগারী !!
হযরত বারা ইবনে আযিব (রদিয়াল্লহু আনহু) হইতে বর্ণিত, রসূলুল্লহ (ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলিয়াছেন, সুন্দর ও ভাল করো কুরআনকে নিজ আওয়াজ দ্বারা; এই জন্য যে, সুন্দর আওয়াজ কুরআনের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়। (মুস্তাদরাকে হাকিম ২য় খন্ড)
আল্লাহ রব্বুল আ'লামীন আল-কুরআনুল কারীমের ১৯ পারা সূরা ফুরকুন রুকু ৩ আয়াত ৩২ এ বলিয়াছেন- وَرَتَّلْنٰهُ تَرْتِيْلَا :
অর্থ: আমি ইহাকে (কুরআন শারীফকে) ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করিয়াছি (বা অবতরণ করিয়াছি)। ২৯ পারা সূরা মুঝাম্মিল আয়াত ৪, وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيْلًا :
অর্থ: (আল্লহ রব্বুল আলামীন রসূল ছল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিতেছেন)
আপনি তারতীলের সহিত (সুবিন্যস্তরূপে ও স্পষ্টভাবে) কুরআন শরীফ আবৃত্তি করুন।
দ্বিতীয়তঃ হযরত আলী (রদিআল্লহু আনহু) বলিয়াছেন-
قَالَ عَلِيٌّ (رَضِـ:) التَّرْتِيْلُ وَهُوَ تَجْوِيْدُ الْحُرُوْفِ وَمَعْرِفَةُ الْوُقُوْفِ .
অর্থ: তারতীল হইতেছে হারফমূহের তাজবীদ ও ওয়াক্ফ সমূহকে জানা।
ভাষাগতভাবে تَرْتِیْل )তারতীল) অর্থ সুন্দর তেলাওয়াত, স্পষ্ট ও সুমধুর আবৃত্তি। অন্য কথায়, মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম যে পঠন ভংগিতে নাজিল হইয়াছে সেইভাবে তিলাওয়াত করাই আমাদের কর্তব্য। শুধুমাত্র তাজবীদের জ্ঞান থাকিলেই তিলাওয়াত শুদ্ধ হইবে না, ওয়াক্তসমূহের জ্ঞানও থাকিতে হইবে। তাজবীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হইতেছে, حُرُوْفٌ الْهِجَاءِ )হুরুফে হিজ্বা) অর্থাৎ আরবী ভাষার ২৯টি হারফকে সঠিক উচ্চারণের মাধ্যমে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করা।
নামাজের মধ্যে তিলাওয়াত ভুল হইয়া অর্থের পরিবর্তন হইলে নামাজ নষ্ট হইয়া যায়। ফলে নামাজী ব্যক্তি নিজের অজ্ঞাতেই গুনাহগার হন। কথিত আছে,
رُبَّ قَارِيْ لِلْقُرْآنِ يَقْرَأُ وَالْقُرْآنُ يَلْعَنْهُ .
অর্থ: "আল-কুরআনুল কারীমের এমন অনেক পাঠক আছে যে, স্বয়ং আল -কুরআন তাহাকে লা'নত (অভিশাপ) করে" অর্থাৎ যাহারা তাজবীদ ব্যতীত আল-কুরআনুল কারীম পড়ে তাহাদিগকে আল-কুরআন অভিশাপ দেয়।
لَحْن (লাহ্হ্ন) অর্থ ভুল। তাজবীদের বিপরীত অর্থাৎ ভুলভাবে তিলাওয়াত করাকে لَحْن (লাহ্হ্ন) বলে। লাহন দুই প্রকার। যথা,
(ক) لَحْنِ جَلِّیِ (লাহ্ জালী), (খ( لَحْن خَفِىَ ) লাহনে খফী(
(ক) لَحْنِ جَلِّیِ (লাহ্ জালী): ইহা ঐ প্রকাশ্য বা স্পষ্ট ভুলকে বলা হয় যাহাতে তিলাওয়াতের সময় অর্থের পরিবর্তন হয়। এই প্রকার তিলাওয়াতে নামাজ নষ্ট হয় এবং তিলাওয়াতকারী গুনাহগার হন। বিভিন্নভাবে এই ভুল হইতে পারে। যেমন,
1) হারকাতে ভুল: যবর, যের ও পেশকে হারকাত বলে। একটি হারকাতের স্থানে অন্য হারকাত পড়া। যেমন, أَنْعَمْتَ এর স্থলে أَنْعَمْتُ পড়া, অর্থাৎ এর উপর পেশ পড়া।
2) সাকিন হাফকে হারকাত দিয়া পড়া। যেমন, الْحَمْدُ لِلّٰهِ এর স্থলে اَلَحَمْدُ পড়া, অর্থাৎ ل এর উপর যবর পড়া।
3) হারকাতযুক্ত হারকে সাকিন পড়া অথবা একেবারেই বাদ দেওয়া। যেমন, وَلِىَ دِيْنِ এর স্থলে وَلْيَ دِيْنِ পড়া, অর্থাৎ ل এর উপর সাকিন পড়া। وَأَشْهَدُ أَنَّ এর স্থলে وَاشْهَدُ أَنَّ পড়া। আলিফের উপরের যবর বাদ দেওয়া।
4) হারফে ভুল: এক হারফের জায়গায় অন্য হাফ পড়া। যেমন, اللَّهُ الصَّمَدُ এর স্থলে اللّٰهُ السَّمَدُ পড়া, অর্থাৎ ص এর স্থলে এ পড়া। الْحَمْدُ এর স্থলে الْهَمْدُ পড়া, অর্থাৎ এর স্থলে এ পড়া।
5) কোন হারফকে বাড়াইয়া পড়া। যেমন, إِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِيْنَ এর স্থলে إِنَّكَ لَا مِنَ الْمُرْسَلِينَ পড়া, অর্থাৎ ل কে এক আলিফ বাড়াইয়া।
6) কোন হারফকে কমাইয়া দেওয়া। যেমন, وَلَا تَكْفُرُكَ এর স্থলে وَلَتَكْفُرُكَ পড়া, অর্থাৎ ل এর পরে। (আলিফ) কে কমাইয়া পড়া। তেমনিভাবে, لَآ إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ এর স্থলে لَإِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ পড়া, অর্থাৎ ل এর মাদকে কমাইয়া পড়া। লামকে না টানা।
7) حَرْفٌ )হারফ) কে তাহার মাখরাজ হইতে আদায় না করা। যেমন, عَلَمِيْنَ এর স্থলে أَلَمِيْنَ পড়া, অর্থাৎ এর স্থলে পড়া।
8) তাশদীদযুক্ত হারফকে বিনা তাশদীদে পড়া। যেমন, اِيَّاكَ এর স্থলে اِيَاكَ পড়া।
9) আরবী হারফ উচ্চারণে এ-কার এবং ও-কার হয় না বরং ই-কার এবং উ-কার উচ্চারিত হয়। এই ধরণের ভুল উচ্চারণ অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন, اِهْدِنَا এর উচ্চারণ ইহদিনা পড়া (এহদিনা না পড়া)। قُلْ أَعُوذُএর উচ্চারণ কুল আউযু পড়া ( কোল আঊযু না পড়া )। লাহনে জালী স্পষ্ট ভুল। তাই ইহা ক্বারীগণ ছাড়া সাধারণ তিলাওয়াতকারীও বুঝিতে পারেন।
(খ( لَحْن خَفِىَ ) লাহনে খফী( : ইহাকে ঐরূপ ভুল বলা হয় যাহাতে অর্থের কোন পরিবর্তন হয় না, কিন্তু উচ্চারণে পড়ার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। এইরূপ ভুল হইতে বাঁচিয়া থাকা একান্ত আবশ্যক। বিভিন্নভাবে এই ভুল হইতে পারে। যেমন,
1) গুন্নাহর স্থলে গুন্নাহ না করা। যেমন, اِنَّ নাকের বাঁশি হইতে উচ্চারণ না করিয়া সাধারণভাবে (ইন্না) উচ্চারণ করা।
2) ইখফাকে ইযহার পড়া। যেমন, اَنْتَউচ্চারণে আংতা না পড়িয়া আন্তা পড়া।
3) ইদগম না করা। যেমন, مَنْ يَّعْمَلْ উচ্চারণে গুন্নাহর সহিত 'মাই ইয়া'মাল' না পড়িয়া সাধারণভাবে 'মান ইয়া'মাল' পড়া।
4) ইক্বলাব না করা। যেমন, مِنْ ۢبَعْدِ উচ্চারণে গুন্নাহর সহিত 'মিম বা'দি' না পড়িয়া সাধারণভাবে 'মিন বা'দি' পড়া।
5) যেখানে পোর বা মোটা উচ্চারণ হইবে সেখানে চিকন বা বারিক উচ্চারণ করা। একইভাবে চিকনের স্থানে মোটা উচ্চারণ করা। যেমন, • رَسُوْلُ اللّٰهِ এর উচ্চারণ রসূলুল্লহ পড়া (রাসূলুল্লাহ না পড়া)। • رَحْمٰنِ الرَّحِيْمِ রহমানির রহীম পড়া (রাহমানির রাহীম না পড়া)।
6) মাদকে সঠিকভাবে না টানা ইত্যাদি।
লাহনে খফী সূক্ষ্ম ভুল। তাই ইহা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্বারীগণই শুধু বুঝিতে পারেন। এই সকল প্রকার ভুল হইতে বাঁচিয়া সঠিকভাবে তিলাওয়াত করা একান্ত কর্তব্য।
What's Your Reaction?